ট্রাম্পের নতুন শুল্ক নীতি কিভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করবে?

গত ২ এপ্রিল হোয়াইট হাউজের রোজ গার্ডেনে দেওয়া “লিবারেশন ডে” ভাষণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেন যে, যুক্তরাষ্ট্র সব আমদানির ওপর ১০% মৌলিক শুল্ক আরোপ করবে। এর পাশাপাশি, প্রায় ৬০টি দেশের ওপর অতিরিক্ত “পাল্টা শুল্ক” ধার্য করা হয়েছে, যা সেই দেশগুলোর মার্কিন পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্কের প্রতিফলন। এই নীতির আওতায় বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ৩৭% শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর গড় শুল্ক ছিল ১৫%। সুতরাং, এই হার এখন দ্বিগুণেরও বেশি। এই সিদ্ধান্ত কেবল দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ককেই নয়, বরং বাংলাদেশের রপ্তানি নির্ভর অর্থনীতিকেও বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে।
আজ আমরা আলোচনা করব ট্রাম্পের শুল্ক নীতির এই পরিবর্তন কিভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে।
প্রথমত, বাংলাদেশের রপ্তানি খাত ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রধানত রপ্তানিনির্ভর, বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অন্যতম বড় রপ্তানি গন্তব্য। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৮.৪ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে ৭.৩৪ বিলিয়ন ডলারই ছিল তৈরি পোশাক। নতুন শুল্কের ফলে এই পণ্যের দাম মার্কিন বাজারে বৃদ্ধি পাবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি শার্ট যার একক রপ্তানি মূল্য ছিল ৫ ডলার, তার ওপর শুল্ক আগে পড়ত ০.৭৫ ডলার। এখন সেই শুল্ক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২.৬ ডলার। অর্থাৎ, প্রতিটি পণ্যে প্রায় ১.৮৫ ডলার বাড়তি খরচ হবে, যা মার্কিন খুচরা মূল্যে প্রভাব ফেলবে। ফলে মার্কিন ক্রেতারা এই পণ্যগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে।
বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলোর ওপরও উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। যেমন, ভিয়েতনামের ওপর ৪৬%, চীনের ওপর ৩৪%, এবং কম্বোডিয়ার ওপর ৪৯% শুল্ক ধার্য করা হয়েছে। তবে, ভারতের ওপর ২৬% এবং পাকিস্তানের ওপর ২৯% শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের তুলনায় কম। এতে করে ভারত ও পাকিস্তান প্রতিযোগিতায় কিছুটা সুবিধা পেতে পারে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ মূলত মধ্যম ও নিম্নমূল্যের পোশাক রপ্তানি করে, যেগুলোর দাম ২০ থেকে ৬০ ডলারের মধ্যে। চীন, ভারত বা ভিয়েতনাম অধিক মূল্যমানের পণ্য রপ্তানি করে থাকে। ফলে, বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান এখনো ধরে রাখা সম্ভব হতে পারে।
এবার জানা যাক অর্থনীতিবিদরা কি মনে করছেন। সিপিডির বিশিষ্ট ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান এর মতে, “বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর ওপরও তুলনামূলকভাবে উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, ফলে বাজার প্রতিযোগিতায় বড় পরিবর্তন না-ও আসতে পারে।” তবে, তিনি সতর্ক করেন যে বিশ্বব্যাপী একটি বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হলে সার্বিকভাবে চাহিদা কমে যেতে পারে, যা বাংলাদেশের রপ্তানিকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করবে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “এই শুল্ক বৃদ্ধির কারণে নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ে প্রভাব পড়বে, তবে মূল চাপ আসবে মার্কিন অর্থনীতিতে চাহিদা হ্রাস পাওয়ার মাধ্যমে।” অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্রে মন্দা দেখা দিলে রপ্তানি চাহিদা কমে যাবে, যা বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর।
বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন যে, বাংলাদেশকে আমেরিকান পণ্যের ওপর বিদ্যমান ৭৪% শুল্ক হ্রাস করে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে নতুন একটি ভারসাম্য গড়ে তুলতে হবে। এতে করে যুক্তরাষ্ট্রও তাদের শুল্ক পুনর্বিবেচনা করতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশ মার্কিন তুলা, সয়াবিন ও স্ক্র্যাপ আমদানি করে, যার ওপর তুলনামূলক কম শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এই তথ্য আলোচনায় কাজে লাগানো যেতে পারে।
এছাড়াও, বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এর মাধ্যমে আমদানি শুল্ক হ্রাসের বিভিন্ন বিকল্প নিয়ে কাজ শুরু করেছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এক ফেসবুক পোস্টে জানান, “যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক সুসংহত রাখতে শুল্ক হার যৌক্তিকীকরণ নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।”
ট্রাম্প প্রশাসনের এই শুল্ক নীতি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে। তবে সঠিক কৌশল, কার্যকর কূটনীতি এবং রপ্তানি বৈচিত্র্য আনার মাধ্যমে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা সম্ভব।