বাংলাদেশের ফুটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি
বাংলাদেশ তার গার্মেন্টস শিল্পের জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিত। তবে, এই দেশের আরেকটি শিল্প ধীরে ধীরে বিশ্ববাজারে স্থান করে নিচ্ছে, সেটি হলো ফুটওয়্যার শিল্প। আজ আমরা জানবো বাংলাদেশের ফুটওয়্যার শিল্পের উত্থান, এর সম্ভাবনা, এবং সামনে থাকা চ্যালেঞ্জসমূহ সম্পর্কে।
বাংলাদেশের ফুটওয়্যার শিল্পের ইতিহাস চামড়া শিল্পের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। ১৯৭০-এর দশকে চামড়া প্রক্রিয়াকরণে দক্ষতা অর্জনের পর, ধীরে ধীরে চামড়া থেকে তৈরি পণ্য, বিশেষ করে জুতা উৎপাদনে মনোযোগ দেয়া হয়। প্রথমদিকে স্থানীয় বাজারে সীমাবদ্ধ থাকলেও, ১৯৯০-এর দশকে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের প্রচেষ্টা শুরু হয়।
বর্তমানে, বাংলাদেশের ফুটওয়্যার শিল্প উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। বিশ্বের বৃহত্তম জুতা রপ্তানিকারক দেশগুলির মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিশেষ করে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের জুতার চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই শিল্পে প্রায় ২ লাখেরও বেশি মানুষ কর্মরত, যার একটি বড় অংশ নারী।
বাংলাদেশের ফুটওয়্যার শিল্পের অন্যতম শক্তি হলো উচ্চমানের চামড়া এবং প্রতিযোগিতামূলক মূল্য। আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলি এখন বাংলাদেশকে তাদের উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে বেছে নিচ্ছে। এর ফলে, দেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী হচ্ছে।
বাংলাদেশের ফুটওয়্যার শিল্পের বিকাশে এপেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর-এর অবদান উল্লেখযোগ্য। তার নেতৃত্বে এপেক্স স্থানীয় বাজারে তাদের যাত্রা শুরু করে ১৯৯৭ সালে। ২৫ বছরের মধ্যে, এপেক্স একটি ছোট ফ্র্যাঞ্চাইজি থেকে দেশের অন্যতম বৃহত্তম ফুটওয়্যার ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে, এপেক্সের ৪৯০টিরও বেশি স্টোর রয়েছে সারা দেশে, যা ৪.৫ মিলিয়নেরও বেশি গ্রাহককে সেবা প্রদান করছে।
এপেক্স গ্রামীণ গ্রাহকদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যের জুতা তৈরি করছে, যা গ্রামীণ অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এই উদ্যোগের ফলে স্থানীয় বাজারে এপেক্সের বিক্রি ১০ শতাংশ এবং মুনাফা ৩১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এপেক্সের নিজস্ব ব্র্যান্ডগুলির মধ্যে রয়েছে এপেক্স, ভেনচুরিনি, নিনো রসি, মুচি, ম্যাভেরিক, স্প্রিন্ট, ডক্টর মক, টুইঙ্কলার এবং স্কুল স্মার্ট। এছাড়াও, নাইকি, এডিডাস, ক্লার্কস, এসিক্সসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের সাথে এপেক্স তাদের রিটেইল যাত্রা এগিয়ে নিচ্ছে।
তবে, এই উত্থানের পথে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। পরিবেশ দূষণ একটি বড় সমস্যা। বিশেষ করে, ট্যানারি শিল্পের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। সরকার সাভারে ট্যানারি শিল্প স্থানান্তর করেছে, তবে সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এখনো নিশ্চিত করা যায়নি।
আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো দক্ষ মানবসম্পদের অভাব। যদিও শ্রমিকরা পরিশ্রমী, তবে আধুনিক প্রযুক্তি ও ডিজাইনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে তাদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। সরকার ও বেসরকারি খাত একসঙ্গে কাজ করে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করেছে, যা ইতিবাচক ফলাফল দিচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ছে। চীন, ভিয়েতনাম, এবং ভারতের মতো দেশগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে, বাংলাদেশকে উদ্ভাবনী ডিজাইন, গুণমান, এবং সময়ম মতো সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া, ব্র্যান্ডিং ও বিপণনে আরও মনোযোগ দেওয়া জরুরি।
সরকার এই শিল্পের উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কর সুবিধা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, এবং সহজ ঋণ সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটির অধীনে নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের মাধ্যমে এই শিল্পকে আরও সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া, স্থানীয় উৎপাদকদের সহায়তার জন্য রপ্তানি প্রণোদনা প্রদান করা হচ্ছে, যা বৈদেশিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে সাহায্য করছে।
ফুটওয়্যার শিল্পের বিকাশ শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক পরিবর্তনও আনছে। গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে।
ভবিষ্যতে, বাংলাদেশের ফুটওয়্যার শিল্পের সামনে সম্ভাবনা অপরিসীম। বিশ্ববাজারে আরও শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে হলে, টেকসই উৎপাদন পদ্ধতি, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, দক্ষ জনবল গড়ে তোলা এবং বৈশ্বিক ট্রেন্ডের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন ডিজাইন তৈরি করতে হবে। এছাড়া, পরিবেশবান্ধব উৎপাদন নিশ্চিত করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর আস্থা অর্জন করা যেতে পারে। এই শিল্পের উন্নতির জন্য সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের জন্য নীতিগত সহায়তা জোরদার করা দরকার।
সব মিলিয়ে, বাংলাদেশের ফুটওয়্যার শিল্প ইতোমধ্যে বিশ্ববাজারে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। যদি সঠিক পরিকল্পনা ও কৌশল গ্রহণ করা হয়, তবে এই শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তিতে পরিণত হতে পারে। বিশ্বমানের জুতা উৎপাদনের মাধ্যমে, বাংলাদেশ শুধু একটি উৎপাদনকারী দেশই নয়, বরং একটি শক্তিশালী ব্র্যান্ড হিসেবেও আবির্ভূত হতে পারে।