বাংলাদেশে ই-কমার্সের উত্থানঃ বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যত সম্ভাবনা

বাংলাদেশে ই-কমার্স খাত বর্তমানে একটি পরিবর্তনশীল, গতিশীল ও উদীয়মান শিল্পে পরিণত হয়েছে। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা এবং প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে অনলাইন কেনাকাটা এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। গত এক দশকে ডিজিটাল ট্রানজেকশন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে, কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে ই-কমার্সের গুরুত্ব আরও বেড়েছে, যখন মানুষ ঘরে বসে নিরাপদে পণ্য ও সেবা গ্রহণের জন্য অনলাইনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। এর ফলে ই-কমার্স দেশের অর্থনীতির একটি অন্যতম সম্ভাবনাময় ও গুরুত্বপূর্ণ খাত হয়ে উঠেছে।
ই-কমার্স বা ইলেকট্রনিক কমার্স হলো কোনো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পণ্য বা সেবা ক্রয়-বিক্রয় করার প্রক্রিয়া। এটি ব্যবসার একটি নতুন ধারা যেখানে ভোক্তা এবং ব্যবসায়ী অনলাইনে যোগাযোগ এবং লেনদেন সম্পন্ন করেন। ই-কমার্সের বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে। যেমনঃ বি-টু-বি (B2B)। এটি হলো ব্যবসা থেকে ব্যবসার মধ্যে লেনদেন। যেমন, প্রস্তুতকারক থেকে পাইকারি বিক্রেতা। এরপরে রয়েছে বি-টু-সি (B2C)। এটি হলো ব্যবসা থেকে সরাসরি ভোক্তার কাছে পণ্য বা সেবা বিক্রি। এর উদাহরণ হলো, দারাজ, চালডাল, ও পান্ডামার্ট এর মতো প্লাটফর্ম। এরপর রয়েছে সি-টু-সি (C2C)। এটি হলো ভোক্তা থেকে ভোক্তার মধ্যে লেনদেন। যেমন, বিক্রয় ডটকম। আরেকটি হলো, সি-টু-বি C2B। এই সিস্টেমে ভোক্তা থেকে ব্যবসার কাছে সেবা বা পণ্য প্রস্তাব করা হয়।
বাংলাদেশে ই-কমার্সের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৯ সালে মুনশিজি ডটকমের মাধ্যমে, যা সিল্ক, হ্যান্ডিক্রাফটস, চা, পাট ও চামড়ার পণ্য বিদেশে রপ্তানি করত। তারপর ২০০৫ ও ২০০৬ সালে চালু করা হয় ক্লিক বিডি ডট কম ও সেলবাজার নামে আরো দু’টো ই-কমার্স সাইট। বাংলাদেশে জোরেশোরে ই-কমার্সের যাত্রা শুরু হয় ২০১১ সাল থেকে। ২০১১ তে এখনি ডট কম নামের ই-কমার্স সাইটটি লঞ্চ করা হয়। পরে যদিও এটির নাম বদলে বাগডুম ডট কম রাখা হয়। ২০১১ তেই আজকের ডিল নামে আরো একটি ই-কমার্স বিজনেস লঞ্চ করা হয়। তারপর ২০১২ তে যখন রকমারি, বিক্রয় ডট কম এবং ২০১৩ সালে চাল ডাল ডট কম ও দারাজের পথচলা শুরু হয়, তখন থেকেই বাড়তে শুরু করে ই-কমার্স বিজনেসের সংখ্যা। বর্তমান সময়ের আরো কিছু সফল কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান হলো অথবা, সাজগোজ, প্রিয়শপ, ও সিন্দাবাদ।
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৯ সাল থেকে বাংলাদেশের ই-কমার্স বিজনেসগুলো নিজেদের প্রচারণা ব্যাপকভাবে বাড়াতে শুরু করে এবং ২০২০ থেকে তারা পুরোদস্তুর ব্যবসা শুরু করে।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় আড়াই হাজারেরও বেশি ই-কমার্স বিজনেস রয়েছে, যেগুলোর ১ শতাংশ বড় পরিসরে, ৪ শতাংশ মাঝারি পরিসরে এবং বাকি ৯৫ শতাংশ ছোট পরিসরে পরিচালিত হচ্ছে। ই-কমার্সের পাশাপাশি বাংলাদেশে প্রায় ৫০ হাজারেরও বেশি এফ কমার্স পেইজ সক্রিয়ভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছে।
আপনারা হয়তো এখন জানতে চাইবেন যে দেশে ই-কমার্স ব্যবসা সম্পর্কিত কোনো লিখিত নীতিমালা রয়েছে কিনা। উত্তর হলো হ্যাঁ, রয়েছে! দেশে প্রতিটি ই-কমার্স ব্যবসা সঠিকভাবে পরিচালনার উদ্দেশ্যে এবং একইসাথে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ করতে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকার ডিজিটাল কমার্স পলিসি প্রণয়ন করেছে, যেখানে ই-কমার্স ব্যবসার বিভিন্ন সমস্যা যেমন: হ্যাকিং, কপিরাইট কিংবা প্রোডাক্টের মূল্যজনিত সমস্যাগুলো সমাধানের দায়িত্ব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে দেয়া হয়েছে। একইসাথে ২০২১ সালের জুনে বাংলাদেশ ব্যাংক পেমেন্ট গেটাওয়ে এসক্রো সার্ভিস চালু করেছে, যা ই-কমার্সকে করে তুলেছে আরো নিরাপদ।
বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। ই-কমার্সের দিক থেকে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান ৪৭ তম। একেবারে শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করা এই ব্যবসা যে দারুণ সম্ভাবনাময় তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
নতুন প্রযুক্তি, পরিবর্তিত গ্রাহক চাহিদা এবং সরকারের সহায়তায় এই খাত আরও বিকশিত হবে। ডাবলিনভিত্তিক বাণিজ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড মার্কেটস ডটকমের মতে, ২০২৬ সালের মধ্যে এই বাজারের আকার প্রায় ১,৫০,০০০ কোটি টাকায় পৌঁছাবে।
ই-কমার্স সেক্টরে ইনভেস্টমেন্টের পরিমাণও আগের চাইতে অনেক বেড়েছে। তাই বলা যেতে পারে, ইনভেস্টমেন্ট বাড়ার কারণে ধীরে ধীরে ই-কমার্স হয়ে উঠছে শক্তিশালী ও লাভজনক একটি ক্ষেত্র।
তবে, এই খাতের দ্রুত বিকাশের সাথে সাথে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। বিশেষ করে, কিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতারণামূলক কার্যক্রমের কারণে গ্রাহকদের মধ্যে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ৩২টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্রাহকের অনেক টাকা পাওনা রয়েছে। ১৮টি প্রতিষ্ঠান এখনও গ্রাহকের টাকা ফেরত দেয়নি। এই ধরনের ঘটনা অনলাইন কেনাকাটায় মানুষের আস্থা কমিয়ে দিতে পারে।
এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর একযোগে কাজ করতে হবে। ডিজিটাল কমার্স পলিসি যেন সঠিকভাবে প্রণয়ন হয় সেই পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলেই ই-কমার্স আরও নিরাপদভাবে বিকাশিত হবে।
তাই বলা যায়, সঠিক নীতিমালা, প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার এবং গ্রাহকের আস্থা অর্জনের মাধ্যমে ই-কমার্স খাত দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে। তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য ই-কমার্স একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করবে।